ড. বিধান রঞ্জন রায়: অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ও একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের জীবন ও কর্ম
বাংলাদেশের ইতিহাসে বিশেষ কিছু মুহূর্তে এমন কিছু ব্যক্তিত্ব উঠে আসেন, যারা দেশের সংকটময় সময়ে দায়িত্ব পালন করে জনগণের আস্থা অর্জন করেন। ড. বিধান রঞ্জন রায় এমনই একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, যিনি বর্তমানে দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার পেশাগত জীবন, শিক্ষা, এবং মনোচিকিৎসা ক্ষেত্রে অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং দেশের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে তার ভূমিকা অপরিসীম।
ড. বিধান রঞ্জন রায় একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং সামাজিক চিন্তাবিদ। তিনি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন এবং ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের প্রধান হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এই নিবন্ধে আমরা তার জীবনী, শিক্ষা, পেশাগত জীবন, এবং সামাজিক চেতনার মনস্ত্বত্ত্ব বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করবো।
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা
অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার ১৯৬৩ সালে সুনামগঞ্জ জেলার এক শিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয় সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলি হাইস্কুলে। ১৯৭৯ সালে এসএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হওয়ার পর, তিনি ঢাকার বিখ্যাত ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। ১৯৮১ সালে এইচএসসি পাস করার পর, তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানে তার ক্যারিয়ার গড়ার লক্ষ্যে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ১৯৮৮ সালে এমবিবিএস সম্পন্ন করার মাধ্যমে তার চিকিৎসা জীবনের যাত্রা শুরু হয়।
পেশাগত জীবন
ডা. বিধান রঞ্জন রায় তার চিকিৎসা জীবনের শুরু থেকেই মনোচিকিৎসার দিকে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের প্রধান হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন এবং সেখানে তার কাজের মাধ্যমে বহু মানসিক রোগীর জীবন পরিবর্তিত হয়েছে। তার অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, এবং নেতৃত্বের গুণাবলি তাকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক পদে উন্নীত করে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে তার নেতৃত্বে মনোচিকিৎসার ক্ষেত্রে বিশেষ অগ্রগতি সাধিত হয়। তিনি মানসিক রোগীদের চিকিৎসায় নতুন নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন এবং মনোচিকিৎসা সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। তার এই সকল উদ্যোগ বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
লেখক হিসেবে অবদান
মনোচিকিৎসার পাশাপাশি ড. বিধান রঞ্জন রায় লেখালেখিতেও দক্ষ। তিনি সমাজের বিভিন্ন সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে লেখালেখি করেন। তার বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে “সামাজিক চেতনার মনস্ত্বত্ত্ব” (২০১৬), “এপিকুরস, আধুনিকতা ও আমরা” (২০১৮), এবং “সিগমুন্ড ফ্রয়েড এবং অফ্রয়েডীয় ফ্রয়েডবাদীগণ” (২০২০)।
তার লেখায় সমাজের বিভিন্ন সমস্যার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ রয়েছে, যা পাঠকদের চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করে। তার লেখা বইগুলো কেবল মনোচিকিৎসার শিক্ষার্থীদের জন্যই নয়, বরং সাধারণ পাঠকদের জন্যও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং শিক্ষণীয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব
ড. বিধান রঞ্জন রায়ের নেতৃত্ব এবং অভিজ্ঞতার কারণে তাকে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত এই নতুন সরকারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন। যদিও তিনি শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি, তবে তার পেশাগত জীবনের অভিজ্ঞতা এবং সামাজিক চিন্তাধারার কারণে তাকে এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়েছে।
ড. বিধান রঞ্জন রায়ের মনোচিকিৎসা সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি
ড. বিধান রঞ্জন রায়ের মনোচিকিৎসা সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত প্রগতিশীল। তিনি বিশ্বাস করেন, মানসিক রোগের চিকিৎসা কেবল ওষুধ নির্ভর নয়, বরং এটি একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া, যার মধ্যে রোগীর মানসিক অবস্থা, সামাজিক পরিবেশ, এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভূমিকা রয়েছে।
তিনি তার চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস এবং সামাজিক চেতনা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করেন। তার মতে, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কেবল রোগের চিকিৎসা নয়, বরং এটি রোগীর জীবনধারার উন্নয়নের জন্যও প্রয়োজনীয়।
সামাজিক চেতনার মনস্ত্বত্ত্ব
“সামাজিক চেতনার মনস্ত্বত্ত্ব” তার অন্যতম প্রধান রচনা, যেখানে তিনি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। বইটিতে তিনি উল্লেখ করেছেন কিভাবে সামাজিক চাপ, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তন মানুষের মানসিক অবস্থার ওপর প্রভাব ফেলে।
তার দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, সমাজের উন্নয়নের জন্য মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মনে করেন, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক উন্নয়ন একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
ড. বিধান রঞ্জন রায় একজন প্রখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, সমাজচিন্তক, এবং লেখক। তার পেশাগত জীবনের সাফল্য এবং সামাজিক চেতনার প্রতি তার দায়িত্ববোধ তাকে একটি বিশেষ স্থানে অধিষ্ঠিত করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে তার ভূমিকা এবং দেশের মনোচিকিৎসা ক্ষেত্রে তার অবদান অনন্য। তার নেতৃত্বে এবং চিন্তাধারায় সমাজের উন্নয়ন এবং মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন সম্ভব হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
ড. বিধান রঞ্জন রায়ের জীবন এবং কর্ম থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। তার মনোচিকিৎসা সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামাজিক চেতনার মনস্ত্বত্ত্ব নিয়ে তার লেখাগুলো আমাদের মনোচিকিৎসা এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধের গুরুত্ব সম্পর্কে নতুন করে চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করে।
আরো পড়ুন:
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ
তরুণ প্রজন্মকে কাজে লাগাবে অন্তর্বর্তী সরকার: রিজওয়ানা হাসান