বাংলাদেশ নামকরণের ইতিহাস: হাজার বছরের পরিক্রমা
প্রথম অধ্যায়: প্রাচীন ‘বঙ্গ’
বাংলাদেশ নামকরণের পিছনে রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস। ‘বাংলা’ শব্দের উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ ‘বঙ্গ’ থেকে। আর্যরা এই অঞ্চলকে ‘বঙ্গ’ বলে অভিহিত করত। বঙ্গে বসবাসকারী মুসলমানরা এই ‘বঙ্গ’ শব্দটির সঙ্গে ফার্সি ‘আল’ প্রত্যয় যোগ করে নাম দেয় ‘বাঙাল’ বা ‘বাঙ্গালাহ্’। ‘আল’ বলতে জমির বিভক্তি বা নদীর ওপর বাঁধ দেয়াকে বোঝাতো। মুসলমান শাসনামলে এবং মোঘল আমলে এই অঞ্চলটি বাঙাল বা বাঙালাহ নামেই পরিচিত ছিল। বাংলাদেশের নাম কীভাবে ‘বাংলাদেশ’ হল?
দ্বিতীয় অধ্যায়: ব্রিটিশ শাসনামল
ব্রিটিশ শাসনামলে এই অঞ্চলের নাম ছিল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় বাংলার পশ্চিম অংশ হয়ে যায় পশ্চিম বঙ্গ এবং পূর্ব অংশ হয়ে যায় পূর্ব বাংলা। ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলে ১৯৪৭ সালে বঙ্গ-প্রদেশ ভারত ও পাকিস্তানে বিভক্ত হয়। পাকিস্তানিরা পূর্ব বাংলার নাম রাখতে চেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান, কিন্তু এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়।
তৃতীয় অধ্যায়: স্বাধীনতার পথচলা
১৯৫২ সালে মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃতি পাওয়ার পর ১৯৫৭ সালে করাচীতে গণপরিষদের তরুণ সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামটির প্রতিবাদ করে বলেন, পূর্ব বাংলা নামের একটি ইতিহাস ও ঐতিহ্য আছে। ১৯৬২ সালে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে নিউক্লিয়াস নামে ছাত্রলীগের একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা পায়। তারা এই অঞ্চলকে স্বাধীন পূর্ব বাংলা বলতেন। ১৯৬৯ সালে আইয়ূব পতন আন্দোলনের সময় প্রথম পূর্ব বাংলাকে ‘বাংলাদেশ’ নামে অভিহিত করা হয়।
চতুর্থ অধ্যায়: বাংলাদেশ নামকরণের ঘোষণা
১৯৬৯ সালের ৫ই ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকীতে শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, ‘আমাদের স্বাধীন দেশটির নাম হবে বাংলাদেশ’। এসময় আওয়ামী লীগের নেতারা বিভিন্ন নাম প্রস্তাব করেন, কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবিত ‘বাংলাদেশ’ নামটি সবাই একবাক্যে মেনে নেন।
স্বাধীনতার পর: বাংলাদেশ নামের প্রতিষ্ঠা
১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকার স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করে এবং দেশটির নাম দেয় ‘বাংলাদেশ’। ১৯৭২ সালের চৌঠা নভেম্বর যখন প্রথম সংবিধান প্রণীত ও গৃহীত হয়, তখনও দেশটির সাংবিধানিক নাম দেয়া হয় ‘বাংলাদেশ’।
সাহিত্যে বাংলাদেশ নামের ব্যবহার
উনিশ শতকের সাহিত্যে অবিভক্ত বাংলাকে ‘বঙ্গদেশ’ বা ‘বাংলাদেশ’ বলা হতো। বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যে ‘বঙ্গদেশ’ শব্দের উল্লেখ আছে। কাজী নজরুল ইসলাম তিরিশের দশকে তার কবিতায় ‘বাংলাদেশ’ নামটি ব্যবহার করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলাকে আখ্যায়িত করেছেন ‘সোনার বাংলা’ বলে আর জীবনানন্দ দাস বলেছেন ‘রূপসী বাংলা’।
সারসংক্ষেপ
বাংলাদেশ নামকরণের পিছনে রয়েছে প্রাচীন ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম। এই নামটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, এই ভূমি তার নিজস্ব পরিচয় এবং ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের নামকরণের ইতিহাস আমাদের স্বাধীনতা এবং জাতীয় চেতনার প্রতীক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুন..