অগাস্ট ১৯৭৫-এর পর প্রচার মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম মুছে ফেলার প্রচেষ্টা
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা-রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর থেকে তাঁর নাম প্রচার মাধ্যম থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। সামরিক সরকার ও পরবর্তীতে ক্ষমতায় থাকা বিভিন্ন প্রশাসন এই প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, যা দীর্ঘ ২১ বছর ধরে চলেছিল। এই লেখায় সেই প্রচেষ্টা এবং এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হবে। শেখ মুজিবুর রহমানের নাম মুছে ফেলার প্রচেষ্টা
শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বেতার থেকে মুছে ফেলা
১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ সালে, হত্যাকাণ্ডের দিন বাংলাদেশ বেতারের ব্রডকাস্ট শাখা থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার ঘোষণা প্রচার করা হয়েছিল। প্রণব চন্দ্র রায়, যিনি সেদিন শিফট ইনচার্জ হিসেবে কাজ করছিলেন, বলেন, “সেদিনই শেষবারের মতো উচ্চারিত হয় শেখ মুজিবুর রহমানের নামটি।” এরপর থেকে বেতারে তাঁর নাম আর কখনও শোনা যায়নি।
সামরিক সরকারের নিষেধাজ্ঞা
ঘটনার দিন মেজর ডালিম ও মেজর শাহরিয়ার রশিদ বেতার অফিসে প্রবেশ করে এবং রেডিওর সব ইকুইপমেন্ট খুলে দিয়ে ঘোষণাটি প্রচার করার নির্দেশ দেন। এতে বলা হয়, “শেখ মুজিবকে হত্যা করা হইয়াছে এবং খন্দকার মুশতাকের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করিয়াছে।” পরবর্তী রেকর্ডিংয়ে শেখ মুজিবকে “হত্যা করা হয়েছে” বলার পরিবর্তে “উৎখাত করা হয়েছে” বলে ঘোষণা দেয়া হয়।
বাংলাদেশ বেতারের নাম পরিবর্তন
খন্দকার মুশতাকের মৌখিক নির্দেশে বাংলাদেশ বেতারের নাম বদলে রেডিও বাংলাদেশ রাখা হয়। সেই সময় থেকে শেখ মুজিবুর রহমান বা তাঁর দলের নাম, রবীন্দ্র সংগীত, এবং জয় বাংলা স্লোগান প্রচার করা নিষিদ্ধ করা হয়।
টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে নিষেধাজ্ঞা
বিটিভিতেও শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বা ছবি প্রচার করা হত না। মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ম. হামিদ বলেন, “২৬শে মার্চ বা ১৬ই ডিসেম্বরের মতো বিশেষ দিনগুলোয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রসঙ্গটি জোড়াতালি দিয়ে কোন রকম দাঁড় করানো হতো।” চলচ্চিত্রেও সেন্সর বোর্ডের মাধ্যমে শেখ মুজিবের নাম, ছবি, ও জয় বাংলা স্লোগান বাদ দেয়া হয়।
পাঠ্যবইতে খণ্ডিত ইতিহাস
শেখ মুজিবুর রহমানের নাম মুছে ফেলার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে, পাঠ্যবইতেও তাঁর নাম উল্লেখ করা হত না। পাঠ্যবইয়ে খণ্ডিত ইতিহাস পড়ানো হতো, যাতে শেখ মুজিবের ভূমিকা উল্লেখ না থাকে।
আওয়ামী লীগের ক্ষমতা ফিরে পাওয়া
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর পুনরায় বাংলাদেশ বেতার নাম ফিরিয়ে আনা হয়। আবু সাঈদ, যিনি তখন তথ্যমন্ত্রী ছিলেন, ‘রেডিও বাংলাদেশ’ নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ বেতার’ পুনঃস্থাপন করেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ ও অন্যান্য রেকর্ডগুলো পুনরুদ্ধার করা হয়।
পরিশেষ
শেখ মুজিবুর রহমানের নাম প্রচার মাধ্যম থেকে মুছে ফেলার প্রচেষ্টা বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি গৌরবময় অধ্যায়কে অস্বীকার করার প্রয়াস ছিল। যদিও ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এই প্রচেষ্টা বন্ধ হয় এবং শেখ মুজিবের নাম ও ইতিহাস পুনরুদ্ধার করা হয়।
শেখ মুজিবুর রহমানের নাম প্রচার মাধ্যম থেকে মুছে ফেলার প্রচেষ্টা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই প্রচেষ্টা শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির নাম মুছে ফেলার চেষ্টা নয়, বরং একটি জাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতির উপর আঘাত ছিল। এই ইতিহাসের পুনরুদ্ধার নতুন প্রজন্মকে তাঁদের পূর্বপুরুষদের সংগ্রাম ও ত্যাগ সম্পর্কে সচেতন করবে এবং তাঁদের মধ্যে দেশপ্রেম ও জাতীয় গর্বের বোধ জাগ্রত করবে।
আরও পড়ুন..