সালমান এফ রহমান, বাংলাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, শিল্পপতি হিসেবে তার খ্যাতি থেকে শুরু করে রাজনীতিতে তার সক্রিয় ভূমিকা পর্যন্ত জীবনের নানা অধ্যায়ে অসাধারণ সাফল্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ১৯৫১ সালের ২৩শে মে ঢাকার দোহার উপজেলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া সালমান এফ রহমানের জীবন কাহিনী শুধু একজন ব্যক্তির সাফল্যগাঁথা নয়, বরং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে তার প্রভাবের একটি দৃষ্টান্ত। সালমান এফ রহমান: বাংলাদেশের শিল্পপতি থেকে রাজনীতিবিদ—এক বিস্ময়কর যাত্রার গল্প
প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা
সালমান এফ রহমানের পিতা ফজলুর রহমান এবং মাতা সৈয়দা ফাতিনা রহমান ছিলেন এক প্রভাবশালী পরিবার থেকে আগত। তাদের কনিষ্ঠ পুত্র সালমান এফ রহমান করাচির নামকরা করাচি গ্রামার স্কুলে পড়াশোনা করেন, যেখানে তিনি ম্যাট্রিক পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরে তিনি সেইন্ট প্যাট্রিক্স স্কুলে চলে যান এবং সেখানে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন। ১৯৬৬ সালে ঢাকায় ফিরে আসেন এবং নটর ডেম কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। এরপর ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক কোর্সে ভর্তি হন। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি করাচি চলে যান এবং সেখানে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ সম্পন্ন করেন।
ব্যবসায়িক জীবনের শুরু: বেক্সিমকো গ্রুপের উত্থান
১৯৬৬ সালে সালমান এফ রহমান এবং তার ভাই সোহেল রহমান পারিবারিক পাটকল চালানোর মাধ্যমে ব্যবসায় প্রবেশ করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পাটকলটি সরকারীকরণ করা হয়। স্বাধীনতার পর, ১৯৭২ সালে তারা বাংলাদেশ এক্সপোর্ট অ্যান্ড ইম্পোর্ট কোম্পানি লিমিটেড (বেক্সিমকো) প্রতিষ্ঠা করেন। বেক্সিমকো গ্রুপ বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম শিল্পগোষ্ঠীতে পরিণত হয়, যা ঔষধ, বস্ত্র, তথ্য প্রযুক্তি, মিডিয়া সহ বিভিন্ন খাতে ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করে।
বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের সাফল্য
১৯৭৬ সালে সালমান এফ রহমান এবং তার ভাই বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানটি দ্রুতই দেশের অন্যতম শীর্ষ ঔষধ উৎপাদক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। বেক্সিমকো ফার্মার ঔষধ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাজারে রপ্তানি হতে শুরু করে এবং এর পণ্যগুলি যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাভ করে। এর ফলে, বেক্সিমকো ফার্মা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে।
ব্যাংকিং ও মিডিয়া জগতে প্রবেশ
ব্যবসার পাশাপাশি সালমান এফ রহমান ব্যাংকিং সেক্টরেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৮২ সালে তিনি এবং তার সহযোগীরা এবি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন, যা বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি ব্যাংক। পরবর্তীতে তিনি আইএফআইসি ব্যাংকের ৩০% শেয়ার ক্রয় করেন এবং ২০১০ সালে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।
মিডিয়া জগতে তার অবস্থানও প্রশংসনীয়। তিনি ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের মালিক এবং দি ইন্ডিপেনডেন্ট পত্রিকার সম্পাদকীয় বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের মিডিয়া জগতে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করে।
রাজনৈতিক জীবনের শুরু: সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আন্দোলন থেকে আওয়ামী লীগ
সালমান এফ রহমান ১৯৯০-এর দশকে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। তিনি ‘সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আন্দোলন’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। যদিও তিনি সেই নির্বাচনে পরাজিত হন, তবে তার রাজনৈতিক জীবনের পথচলা এখানেই থেমে যায়নি। পরবর্তীতে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে পরিচিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি ঢাকা-১ আসন থেকে নির্বাচন করে পরাজিত হন, কিন্তু তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার এখানেই শেষ হয়নি।
আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে, সালমান এফ রহমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি পূর্ণ মন্ত্রীর পদমর্যাদায় এই দায়িত্ব পালন করেন এবং দেশের বেসরকারি খাতের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। তার উদ্যোগে বাংলাদেশের ইজ অফ ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্সে উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে, যা দেশের বিনিয়োগ পরিবেশকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলে।
বিতর্ক ও সমালোচনা
সালমান এফ রহমানের জীবনের সাফল্যের পাশাপাশি কিছু বিতর্কও রয়েছে। ২০০৭ সালে উইকিলিকস কর্তৃক প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, তিনি বাংলাদেশের অন্যতম বড় ব্যাংক ঋণখেলাপি ছিলেন। ২০০৬-০৮ সালের রাজনৈতিক সংকটের সময় তিনি ১১টি মামলায় গ্রেফতার হন, যদিও পরে উচ্চ আদালত তাকে জামিন প্রদান করে এবং শেয়ার বাজার জালিয়াতির মামলাও বাতিল করে দেয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ও সাম্প্রতিক পরিস্থিতি
২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় দেশের রাজনীতিতে এক বড় পরিবর্তনের সূচনা হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফলে শেখ হাসিনার সরকার পতিত হয় এবং সালমান এফ রহমানসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা আত্মগোপনে চলে যান। ১৩ আগস্ট ২০২৪ সালে সালমান এফ রহমান ঢাকা সদরঘাটে নদীপথে পালিয়ে যাওয়ার সময় গ্রেফতার হন। তার এই গ্রেফতার বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করে।
এক অবিস্মরণীয় জীবন
সালমান এফ রহমানের জীবন কাহিনী এক অনন্য সংগ্রামের প্রতীক। তার সাফল্য এবং বিতর্কময় কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। তার ব্যবসায়িক দক্ষতা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং সামাজিক অবদান দেশের প্রেক্ষাপটে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে।
তবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে তার রাজনৈতিক ভূমিকা ও ভবিষ্যতের সম্ভাব্য পরিবর্তন কীভাবে দেশের উন্নয়নে প্রভাব ফেলবে, তা সময়ই বলে দেবে। সালমান এফ রহমানের জীবন একাধারে সফলতা এবং চ্যালেঞ্জের মিশ্রণ, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে লেখা থাকবে।
আরো পড়ুন:
আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমানের গ্রেফতারের বিশ্লেষণ
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ছবি গ্রামীণ ব্যাংকের সামনে
ইউনূসহীন গ্রামীণ ব্যাংক কেমন করছে